উলঙ্গ সিনেমার দর্শক, এবং একটি হারিয়ে ফেলা মহাকাব্য : প্রদোষ পাল : বাক্‌ ১০৮

দেশ বিদেশের ভালো সিনেমা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েই ‘নন্দন’ প্রেক্ষাগৃহ তৈরি হয়েছিল। আমার জীবনের ভালো সিনেমা দেখার স্বাদ ও সুযোগ নন্দনেরই কল্যাণে। যদিও প্রতিষ্ঠার বছর দশেক বা আর কয়েক বছর পর থেকেই 'নন্দন' তার জায়গা হারাতে শুরু করেছিল। পরের দিকে নন্দন আর তেমন ভালো সিনেমা আনতো না। এই অধঃপতনের শুরু বোধহয় 'রুদালি' সিনেমা মুক্তির হাত ধরে। সেবার 'রুদালি' (১৯৯৩) সম্ভবত পূর্বাঞ্চলে একমাত্র নন্দন প্রেক্ষাগৃহেই মুক্তি পেয়েছিল। মারাত্মক প্রচার মুক্তির আগেই ছবিটিকে ভীষ জনপ্রিয় করে, ফলে রুদালি দেখার জন্য নন্দন প্রাঙ্গনে মানুষের যে ঢল নেমেছিল তা নন্দনের ইতিহাসে কখনও ঘটেছিল বলে মনে হয়নাসেই প্রথম নন্দন বোধহয় রক্তের স্বাদ পেয়ে গেল। তারপর হলিউডের স্ট্যালোন মার্কা ছবি থেকে হিন্দিবাংলা-র মারকাটারি ছবি দেখানো শুরু কদাচিৎ কিছু ভালো ছবি মাঝে মধ্যে আসতো। তারপর 'নন্দন' থেকে আমারও দুরত্ব আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল।
কিন্তু ভালো ছবি দেখার খিদে মেটাবো কী করে? সে সময়ই ‘সিনে সেন্ট্রাল’এর সদস্যপদ গ্রহন করলাম। যাঁরা এ ব্যাপারে একটু আধটু জানেন তাঁরা বুঝতে পারবেন কলকাতার যতগুলো সিনেক্লাব, তার মধ্যে ‘সিনে সেন্ট্রাল অফ ক্যালকাটা’ অন্যতম। বর্তমানে হয়তো সিনে সেন্ট্রালের তেমন গ্ল্যামার নে‌ই, কিন্তু একটা সময় যখন অলোক চন্দ্র চন্দ্র সম্পাদক ছিলেন সবাই জানেন তখন কি জায়গা ছিল সিনে সেন্ট্রালের। দেশ বিদেশের ভালো ভালো সিনেমা নিজের হাতে বেছে নিয়ে আসতেন। তাঁর উদ্যোগেই প্রথম এ ধরণের সিনে ক্লাবের মধ্যে ‘সিনে সেন্ট্রাল অফ ক্যালকাটা’-র ব্যবস্থাপনায় ‘ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভাল’ শুরু হয়েছিল। শুধু ভালো ছবি দেখানো নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সিনেমা পরিচালকদের নিয়ে আসতেন। দর্শকরা তাঁদের সঙ্গে মত বিনিময় করতেন। পরে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রনাধীন ‘ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভাল’ বন্ধ হওয়ার পর বুদ্ধদেব বাবু (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী) রাজ্যসরকারের উদ্যোগে চলচ্চিত্র উৎসব শুরু করলেন (১৯৯৮) অলোকবাবুর পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া যা সম্ভব ছিল না। তাই প্রথম দিকে এই ফেস্টিভালের সহযোগিতায় সিনে সেন্ট্রালের নাম লেখা থাকতো। এদিকে কিছু টেকনিক্যাল কারণে সিনে সেন্ট্রালের নিজস্ব ফেস্টিভ্যাল নাম পরিবর্তন করে ‘ইন্টারন্যাশানাল ফোরাম ফর নিউ সিনেমা’ হলো
আমার মতে এর পরই সিনে সেন্ট্রালের অধঃপতনও শুরুসরকারের সঙ্গে তাল মেলাতে একদিকে যেমন তারা তাদের নিজস্বতা হারালো অন্যদিকে ছবি বাছাইয়ের একাগ্রতা কমতে শুরু করল।  কমতে কমতে সিনে সেন্ট্রালের নিজস্ব ফেস্টিভালের উন্মাদনার ফোকাসও ঘুরে গেল। দুমকরে অলোকবাবু চলে গেলেন। তার পর কি হয়েছে কি হচ্ছে সবাই দেখতে পাচ্ছে। তবে একটা কথা বলাও বোধহয় দরকার ভালো ছবি দেখানোর যথোপযুক্ত পরিশ্রম ও ব্যবস্থা অলোক বাবুর করার চেষ্টা করলেও সিনে সেন্ট্রাল খুব ভালো দর্শক যে তৈরি করতে পেরেছে তা কিন্তু বলা যাবে না। নিজে খুবই সাধারণ থাকতেন। বেটেখাঁটো, পরনে ধুতি পাঞ্জাবি ধর্মতলার ২নং চৌরঙ্গী রোডে পুরোনো জরাজীর্ণ বাড়ির দোতলায় এক এঁদোঘরে বসতেন। দেশ বিদেশের ভালো ছবি আনার খরচ, সিনে সেন্ট্রালের নিজস্ব উদ্যোগে ফিল্ম ফেস্টিভাল করার বিপুল খরচ বহন করতে গেলে সদস্য সংখ্যা বাড়াতেই হতো। আর সদস্য বাড়াতে গেলে বাছবিচারও হয়তো চলে না।
আন সেন্সার্ড সিনেমা দেখার আকর্ষনে বিন্দুমাত্র ভালো সিনেমার সঙ্গে যাদের যোগ নেই পয়সাওয়ালা একশ্রেনির ব্যবসাদার আর বিকৃত মানসিকতার সদস্য বাড়তে লাগল। আজ নাহয় সব খু্ল্লাম খুল্লা। সেভেন এইটের ছেলেমেয়েদের মোবাইলে আন সেন্সর্ডের বাবার বাবারা লোড করা রয়েছে। তখন কোনো সিনেমায় একটু আধটু যৌনতা চাক্ষুস করার জন্য কী অসম্ভব মারপিঠ টাকাওড়ানো চলত তা আমাদের সময়ের মানুষরা জানেন। যাই হোক ওই ছোঁকছোঁক শ্রেণির দর্শকরা ওঁৎ পেতে থাকতেন কখন আ-কাট দেখা যাবে। একটু আধটু গন্ধ পেলেই হল উপচে পড়ত। বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার ছবি হলে তো কথাই নেই। ছবি শুরুর দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই এরা বুঝে নিতেন তেমন মশলা আছে কিনা! মশলা না থাকলে যাদের হাতে সময় থাকতো তারা নিদ্রাটা হলে বসেই সেরে নিতেন, বাকিরা হল ফাঁকা করে বেরিয়ে পড়তেনযাওয়ার আগে হতাশা প্রকাশ করতেন দুমদাম চেয়ার নাড়িয়ে।                      
এমনই একদিনের ঘটনা দিয়ে আসল আলোচনায় আসা যাক। সেবার সরলা মেমোরিয়াল হলে (পি জি হাসপাতালের বিপরীতে) সিনে সেন্ট্রাল কয়েকটা সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। একদিন ছিল ব্রাজিলের একটি ছবি। ইংরেজি তর্জমায় নাম ‘দ্য পার্টি’। একে ব্রাজিল তাতে সিনেমার নাম আবার ‘দ্য পার্টি’, দুয়ে দুয়ে চার হয়েই তো গেল। সরলা হলে আনুমানিক আটশো আসন কানায় কানায় পূর্ণ। যারা জায়গা পেলেন না সিঁড়িতেই বসে পড়লেন। দশ পনেরো মিনিট পর হল প্রায় ফাঁকা। সাকুল্যে দশ বারোজন শেষ পর্যন্ত সিনেমাটা দেখেছে। আমি অধম তার মধ্যে একজন। উপরে যে শ্রেণির কথা বলছিলাম, সব দর্শকই তো আর তা নন। তবে কেন এমন হলো? প্রায় পঁচিশ বছর পর যেটুকু মনে আছে, সে ছবির বর্ণনা থেকে হয়তো কিছুটা আঁচ করা সম্ভব।                  


                 
।।প্রথম দৃশ্য।।
বিকেলের আলো একটি বাড়ির বৈঠকখানায় এসে পড়েছে। খালি সোফা চেয়ারের ওপর দিয়ে ক্যামেরার চোখ ঘুরে গেলকিছুক্ষন পর সদর দরজা দিয়ে একজনের ভেতরে প্রবেশগৃহকর্তা এগিয়ে কিছু কথা বললেন। আগন্তুক সোফায় এসে বসলেন। আরও কিছু বাদে আর একজন, গৃহকর্তা তাঁর সঙ্গেও কিছু কথা বলার পর তিনিও এসে বসলেন। এভাবেই জনা চারেক সোফায় এসে বসলেন। 


    
‌।। দ্বিতীয় দৃশ্য।।
সন্ধ্যা নামল। একে একে আরও কিছু নারীপুরুষ সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এলেন। এবার যিনি বা যাঁরা এলেন বা একে একে আসতে দেখা গেল তাঁদের থেকে পূর্বে যাঁরা এসেছিলেন তাদের অনেক তফাৎ। পরে যাঁরা আসছেন তাঁদের বেশভুষা চলন বলন দেখেই বোঝা যায় এঁরা উচ্চশ্রেনীর। গৃহকর্তা পূর্বের অথিতিদের সঙ্গে শুধু কথা বলে সোফায় বসিয়ে ছিলেন। এঁদের কারও সঙ্গে করমর্দন, কাউকে জড়িয়ে ধরে ওয়েলকাম জানালেন। এঁরা কেউ বৈঠকখানার সোফায় বসলেন না, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন। কিছুক্ষন পর একজন অত্যন্ত আধুনিক পোশাক পরিহিতা লাস্যময়ী গাড়ি থেকে নামলেন, সঙ্গে বেশকিছু সুবেশ পুরুষ। বোঝা গেল, ঐ লাস্যময়ী কোনো নামকরা সেলিব্রিটি। অভিনেত্রীও হতে পারেন। গৃহকর্তা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে গেলন। কল-কল ধ্বনিতে পুরো পরিবেশ মুখর হয়ে উঠল যেন। প্রথম আসা অতিথিরা সোফায় বসে হাঁ করে লাস্যময়ীকে দেখতে থাকলেন। প্রায় নাচতে নাচতে সদলবলে ওপরে উঠে গেলেন লাস্যময়ী যতদূর চোখ যায় প্রথম আসা অতিথিরা সেদিকে চেয়ে থাকতে লাগলতাদের চোখদিয়ে দর্শকদের চোখও সিঁড়ির শেষধাপে গিয়ে আটকে গেল। কানে আসতে লাগল শুধুই কোলাহল আর হৈ হুল্লোড়ের শব্দ। ইতিমধ্যে আরও বহু উচ্চশ্রেণির নারীপুরুষ এসে ওপরে চলে গিয়েছেন। ‌সিঁড়ি দিয়ে এবার পর পর উঠতে লাগল ট্রে ভর্তি নানান সুস্বাদু খাবার আর অবশ্যই দামি পানীয়। সোফায় বসে থাকা মানুষগুলো... এতক্ষন এঁদের অতিথি বলে পরিচয় দিচ্ছিলাম, কিন্তু এরপর আর অন্তত ওদের অতিথি বলা যায় না। শুধুই মানুষ। মানুষগুলো ফ্যাল ফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেও কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না। ওঁদের একজন ট্রে ওয়ালার কাছে গিয়ে একপাত্র পানীয় চাইলেন, পাত্তা পেলেন নাওপর থেকে তীব্র চিৎকার ভেসে আসছে তখনটুংটাং পেয়ালার শব্দ, কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। না সোফায় বসা মানুষগুলো কিছু দেখতে পাচ্ছেন, না দর্শকরা কিছু দেখতে পাচ্ছে। ওদের সঙ্গে আমাদের মতো দর্শকরা ভেড়ুয়ার মত বসে বসে শুধু হুল্লোড়বাজির শব্দ শুনে চলেছি ওই অভাগা মানুষগুলোর আসনে কখন যেন আমাদের মতো দর্শকরাও বসে পড়েছে! 

    

।। তৃতীয় দৃশ্য।।
বৈঠকখানায় একপাশে রাখা ছিল একটি বিলিয়ার্ডের টেবিল। একজন নিজে নিজেই ঠকাস ঠকাস করে খেলে চলছিল। মাঝে মাঝে ওপরে তাকাচ্ছে, হতাশ হয়ে আবার বিলিয়ার্ডের বলে তাক করছে। বোঝা যাচ্ছে তার মন নেই কিন্তু সময় কাটানোর জন্য এ ছাড়া আর যেন তার কিছু করারও মেই। অন্যান্যদেরও একই অবস্থা। কারো কিছু করার নেই। দর্শকদেরও একই অবস্থা। সোফায় বসে থাকা একজন উঠে দাঁড়াল। বসে বসে যেন হাত-পায়ে খিল ধরে গিয়েছে, তাই হাত পা ছুড়ে খিল সরাতে লাগল। শুরু করল বিভিন্ন ধরনের জিমন্যাস্টিক। কিছুটা পরিষ্কার হলো ওদের আগমণ। কেঊ বিলিয়ার্ডে পারদর্শী, কেউ জিমন্যাস্টিকে, কেউ তাস খেলায়, কেউ বিভিন্ন হাসির জোকসের জন্য। এদের ডাকা হয়েছে পার্টির এন্টারটেনার হিসেবে। একজন আস্তে আস্তে সিঁড়ির কয়েক ধাপ ওপরে উঠে পার্টির হুল্লোড়বাজি দেখার চেষ্টা করল। তার চোখদিয়ে দর্শকদেরও দেখার চেষ্টা কিন্তু দোতলার যে ঘরে পার্টি হচ্ছে সে ঘরের দরজা বন্ধ। দরজার নিচদিয়ে কিছু নারীপুরুষের টালমাটাল পা দেখা গেল মাত্র। হতাশ হয়ে বেচারা নিচে নেমে এল। হতাশ হলাম আমরাও, মানে দর্শকরা। কিছুক্ষন পর ওপরের দরজা খোলার শব্দ, তীব্র রঙিন আলো এসে পড়ল সিঁড়িতে। সবার চোখ তখন সে দিকেই। হুড়মুড় করে লাস্যময়ী আর তার অনুচররা টলতে টলতে নিচে নেমে এলেন। তৎক্ষণাৎ বিলিয়ার্ড মাস্টার তার কসরৎ দেখাতে শুরু করলেন। লাস্যময়ী বিলিয়ার্ড খেলার লাঠিটা নিয়ে একবার গুটিতে মেরেই চম্পট দিলেন আর একদিকে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আর একদিকে যেতেই জিমন্যাস্টিক মাস্টার খেলা দেখাতে শুরু করলেন। যদিও লাস্যময়ী সেদিকে তাকালেনই না। যেভাবে হুড়মুড় করে নেমেছিলেন সেভাবেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন। দেড় থেকে দু মিনিটের সফর।

        
।। চতুর্থ দৃশ্য।।
সবাই হতাশ। যারা নানান কসরত দেখানোর জন্য এতক্ষন বসেছিল, তারা কিছু দেখানোর সুযোগই পেলেন নাআর আমরা দর্শকরা? যদিও বা লাস্যময়ী  নেমে এলেন, কিছু না কিছু তার কান্ডকারখানা দেখার আশায় ছিলাম, সব জলে গেল! সোফার মানুষগুলো এবার একেবারেই মুহ্যমান। এতক্ষন তবুও একটা ছটপটানি ভাব দেখা গিয়েছিল। এখন সবাই নুয়ে বেঁকে গিয়েছে যেন। আমারাও তখন ওদের অবস্থানে।  



।। পঞ্চম দৃশ্য।।
কখন যেন পার্টি শেষ হয়ে গিয়েছে। সবাই চলেও গ্যাছে। আস্তে আস্তে ভোর হতে দেখা গেল। গৃহকর্তা সোফায় বসা নুয়ে পড়া মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন। হাতে টাকা। সবাইকে পেমেন্ট করবেন বলেই এসেছেন। এক একজনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন কিছু করে টাকা। সবার মুখ তখন নিচুকেউ টাকা নিতে চায় না। অপমানিত। যে জন্য তাদের ডাকা হয়েছিল তা যখন তাদের করে দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি তখন কি করে তারা টাকা নেয়! মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলগৃহকর্তা আরও কয়েকবার টাকা নিতে অনুরোধ করলেন। অবশেষে তারা মুখ নিচু করেই একে একে বাড়িয়ে দিলেন হাত। 

     তাদের শিল্পী সত্ত্বা প্রতিবাদ জানিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বাস্তবতার কাছে শিল্পীসত্ত্বাকে হার মনতে হলো। কারো স্ত্রী কারো ক্ষুধার্ত সন্তান হয়তো পথচেয়ে বসে রয়েছে ওই সামান্য কটা রোজগারের টাকার জন্য। 
‌     বাইরে ঝির ঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তখন। তারা চারজন আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে পড়ল বৃষ্টি মাথায় মিয়ে। বেশ কয়েক মিনিট বৃষ্টি চলল পর্দা জুড়ে। সমস্ত গ্লানি অপমান যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে। শিল্পীর অপমান হয় না, শিল্পীকে যাঁরা অপমান করেন অপমান হয় তাঁদের।
।। ছবি শেষ।।

‌মাত্র গুটিকতক দর্শকের মধ্যে পাথরের মতো বসে ছিলাম বেশ কিছুক্ষন। এ কী দেখলাম! কী ভাষায় এর ব্যখ্যা করবো! বিংশ শতাব্দীর শেষ গোড়ায় এমন ছবি কেউ বানাতে পারে! চারদিকে এতো প্রয়োজনের ভীড়ে....!  না আছে কোনো ক্যামেরার দুর্দান্ত শট, না আছে কোনো মনে রাখার মতো অভিনয়, না কোনো স্পর্শ করার মতো আবহ সংগীত। তবে কী! এ্যাতো বছর পরও প্রতিটি দৃশ্য যেন আমি দেখতে পাচ্ছি। আফসোস শুধু একটা, আমার অপরিনামদর্শিতায় পরিচালকের ও সিনেমাটির সঠিক নাম মনে রাখিনি। আজকের দিনে গুগুল সার্চ করে সমস্ত ঠিকুজি কুষ্ঠি বের করে ফ্যালা যেত। তখন এসব সম্ভব ছিল না। বন্ধুবান্ধবদের কাছে যখন এ ছবির গল্প বলেছি, সবাই উদগ্রীব হয়ে শুনেছে। তাদেরও আফসোস ঝরে পড়েছে। সত্যিই যদি একবার দেখা যেত! তবে আমার বিশ্বাস সিনেমাটির হুবহু বর্ণনা তাদের যতটা আকৃষ্ট করেছে, হলে বসে ক'জন এ ছবি শেষ পর্যন্ত দেখত বা দেখার ধৈর্য্য দ্যাখাতো সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এও আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি সেদিন যারা হল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তারা আমার বর্ণনা এমন করে শুনলে হয়তো আফসোস করতেন। 

‌আসলে আমরা যারা ভালো ছবি ভালো ছবি বলে চ্যাঁচাই, আমরা কি সত্যিই জানি কোনটা ভালো? বিশ্বজোড়া নাম আর কায়দা কসরত অনেক সময়ই হয়তো ভালো ছবি বলে বিশ্বাস করতে শিখিয়ে দ্যায়। বিদগ্ধ আলোচনায় যে সব পরিচালকদের নাম না বললে হয়তো আমাদের মান থাকে না। কিন্তু ক’জনকে এমন ছবি বছরের পর বছর তাড়িয়ে বেড়ায়? এমন অনামা একজন পরিচালক সহস্র মাইল দূরের আমার মতো কয়েকজনকে আজও স্বপ্ন দেখতে শেখায়, শেখায় জীবনকে ভালোবাসতে? এক মাধ্যমের আর একজনের ভালো ছবি দেখার খিদে এভাবে বাড়িয়ে দ্যায়? এর থেকে স্বার্থক সৃষ্টি আর কী হতে পারে? সিনেমা মূলত বিনোদন জগতেরই একটি শিল্প মাধ্যম। পরিচালক একটি সিনেমা তৈরি করেন দর্শকের কথা ভেবেই তো! প্রায় দেড় দু ঘন্টার একটা সিনেমা আনুমানিক কত খরচ হতে পারে আমরা কমবেশি সবাই জানি। অথচ ‘দ্য পার্টি’র পরিচালক এমন একটা সিনেমা বানালেন যা থেকে দর্শকের বিনোদনের প্রাপ্তি শূন্যএমন একটা দৃশ্য নেই যেখান থেকে দর্শকরা এক শতাংশ বিনোদন সংগ্রহ করতে পারেন। সামান্য অভিনয় দক্ষতা, সামান্য সুরের মুর্ছনা যা দর্শককে মুহূর্তের জন্যও বিনোদন দিতে পারে, তা এ সিনেমাতে নেই এর পরেও যিনি এমন একটা সিনেমা বানান তাকে কী বলবো? পাগল? ব্রাজিল নামক দেশটির আর্থিক সচ্ছলতা এমন নয় যে এধরণের সিনেমার জন্য কেউ টাকা ঢালবে! হয়তো পরিচালক নিজেই ছবির খরচ জোগাড় করেছেন। শুনেছিলাম সত্যজিৎ রায় নাকি গয়না বিক্রী করে জীবনের প্রথম সিনেমা 'পথের পাঁচালি' করেছিলেন। পথের পাঁচালিতে ভালো ছবির মহান উপকরণের সঙ্গে বিনোদনেরও যে বহু উপকরণ ছিল, এ কথা অস্বীকার করা যায় কী? অথচ ‘দ্য পার্টি’ ছবিটির কথা একবার ভাবুন!    


বিঃ দ্রঃ যদি কোনো বন্ধু আমার মতো সেদিন ছবিটি দেখে থাকেন, বা পরেও কোনো সন্ধান পান দয়াকরে জানাবেন। 

(সম্পাদকীয় নোট : সিনেমাটির কোনো ছবি পাওয়া গেল না। এই গদ্যে ব্যবহৃত সব ছবিই প্রদোষ পাল এঁকেছেন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮-এর মধ্যে।)

11 comments:

  1. প্রদোষবাবু যে ফিল্মটির কথা বললেন, যদি খুব ভুল না হয় ফিল্মটির নাম ফেস্টা (১৯৮৯), পরিচালক উগো ঘুওরঘেট্টি (Ugo Giorgetti)। একটি রাতে এক অভিজাত প্রতিক্ষা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি ঠিকই বলেছেন। প্রায় ২২,২৪ বছর আগে একবার একটি সো-এ দ্যাখা। কিছু দৃশ্যের অদল বদল হতে পারে...কিন্তু ওই অসাধারণ ছবিটির কথা ভুলতে পারিনি ...পারবও না কোনোদিন। আবার আপনাকে ধন্যবাদ 'হারিয়ে ফেলা মহাকব্য'র সন্ধান দেওয়ার জন্য। 'বাক'-কেও ধন্যবাদ, তাঁরা যদি আমাকে লেখার সুযোগ করে না দিত তাহলে আমি হয়তো এ জীবনে ঐ মহাকাব্যের সন্ধান পেতামই না।

      Delete
  2. দারুন আলোচনা। ছবিটি দেখার স্বাদ বেড়ে গেল ...

    ReplyDelete
  3. চিত্রকল্পে ফুটে ওঠা কবিতা।
    পর্দায় চলচ্চিত্রের ক্যানভাস হয়ে ওঠা।
    এমন আরও চলচ্চিত্রের কথা ফিরে আসুক বাক্‌ এর পাতায়।
    দারুণ একটি বিভাগ হয়ে উঠছে এটি।

    ফিরে ফিরে আসতে ইচ্ছে এমন বিভাগে, পছন্দের বিষয়টি আবার খুঁজে নিয়ে নতুন করে দেখতে, জানতে, শিখতে।

    :)

    - জয়দীপ।

    ReplyDelete
  4. https://m.youtube.com/watch?v=clq3SZfLdMM

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি এই রকম কিছু ভাল ছবির youtube এর লিংক দিতে পারেন আমার খু দেখার ইচ্ছে আছে..
      যদি কিছু না মনে করেন...

      Delete
  5. সম্ভবত উপরের কমেন্টে লিঙ্কটা কাজ করবে না । তবে, ওটাই কপি পেষ্ট করে সার্চ দিলে "Festa" সিনেমাটা খুঁজে পাওয়া যাবে ।

    ReplyDelete
  6. বহু বছর পর আবার ছবিটা আজ দেখলাম। ইন্দ্রনীল বাবুর কল্যানে যেটা সম্ভব হলো। আজ আবার নতুন করে ছবিটা থেকে কতকিছু আবিষ্কার করলাম। ২২, ২৪ বছর আগে কত কিছু চোখ এড়িয়ে যাওয়া আবার নতুন ভাবে ধরা দিল। আরো অনেক সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  7. প্রদোষবাবু,সিনেমা নিয়ে আপনার আলোচনা ভাবাচ্ছে। আপনার ছবিও। আজ দেখব সিনেমাটি। গত সংখ্যায় আপনার লেখাটি পড়ার পর অনুপমের লিংক পেয়ে আগে মাথায় এল, প্রদোষবাবু এই সংখ্যায় লিখেছেন তো? ওই যে 'ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট'-এর খোঁজ দিলেন!

    ReplyDelete
  8. ধন্যবাদ, ছবি নিয়ে ভাবানো ও ভালো সিনেমা দেখার আগ্রহ বাড়া দুটোই আমার সামান্য লেখার প্রাপ্তি। ভালো থাকবেন ভাই।

    ReplyDelete
  9. landscape in the mist dekhlam.dhannobad apnake.

    ReplyDelete