[অষ্টম পর্ব]
আকাশে
চাঁদের আলো—উঠানে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—
এমন
চাঁদের আলো আজ
বাতাসে
ঘুঘুর ডাক—অশথে ঘুঘুর ডাক—হৃদয়ে ঘুঘু যে ডাকে—
নরম ঘুঘুর
ডাক আজ
—‘আকাশে চাঁদের আলো’,
জীবনানন্দ দাশ
তারা
গণ্ডযোগে জনম আমার
ধলুয়াবাড়ি গ্রামের আরশিনগর লালন আশ্রমে আটচালার ঘরে, মাটিতে
ব’সে গান গাইছেন রামপ্রসাদ। দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে লোক এসেছে সে গান শুনতে।
লোকজনের ভিড়ের ভেতর ব’সে গান শুনছেন কমলকুমার মজুমদার আর বঙ্কিমচন্দ্র। গানের
ফাঁকে ফাঁকে কথাবার্তাও হচ্ছে। তত্ত্ব কথা। সাধনমার্গের কথা। লালন সাঁই নিজে ডেকে এনেছেন রামপ্রসাদকে। কিন্তু এই আসরে লালন নেই। তিনি ছোট্ট
একটা ঘোড়ায় চেপে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছেন। চারপাশে বেতবন। কুটীরের উঠোনে ব’সে বেতের
ঝুড়ি বুনছে চাষি। পাশে তার শিশুপুত্র ব’সে পড়ছে সহজ পাঠ। দ্বিতীয় ভাগ। রামপ্রসাদ
চোখ বুঁজে গান গাইতে গাইতে থেমে যান। ব্যাখ্যা দেন শাক্ত দর্শনের। তাঁর দুই ভ্রূর
মাঝখানে, নিচের দিকে মোটা ও ক্রমে সরু হতে হতে শেষে তীক্ষ্ণ হয়ে সোজা উঠে গেছে
কুশীদ। লন্ঠনের আলো প’ড়ে যা মাঝেমাঝেই ঝিকিয়ে উঠছে।
—‘এই বিশ্বপ্রবাহে যা কিছু আমরা
দেখি তা মূলগত এক শক্তিরই বিভিন্ন প্রকাশ। চৈতন্যের এই প্রবাহকেই বলা হয় শক্তি।
এই প্রবাহ অসীম ও অদ্বৈত। কিন্তু সৃষ্টির প্রয়োজনে অদ্বৈতই দ্বৈতে রূপান্তরিত হন। জেগে ওঠেন চৈতন্যের দুই রূপ, শিব ও শক্তি। দেবীই সর্বোচ্চ ও পরম দৈব। পৃথিবীর
কোনও ধর্মীয় ইতিহাসে কোথাও এইরকম সম্পূর্ণ নারীতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর দেখা যায় না।
শক্তির সাথে মিলিত হ’লে তবেই শিব সৃষ্টিক্ষম হন। নইলে তাঁর একটা আলোড়ন তোলারও
ক্ষমতা নেই। শিব হলেন জড়রূপী শক্তি। আর শক্তি হলেন জীবনরূপী শিব। শক্তি
প্রকৃতিরূপে তাঁর নারী সত্ত্বাকে অতিক্রম করেন তাকে অস্বীকার না করেই।’
ভিড়ের ভেতর থেকে বঙ্কিমচন্দ্র প্রশ্ন
করেন, ‘মার্জনা করবেন রামপ্রসাদ, হিন্দু ধর্মের অনেক ব্যাখ্যার মধ্যে একটা হ’ল,
হিংসয়া দূরতে চিত্তং তেন হিন্দুরীতিরীতঃ। হিংসাতে যাঁর মন ব্যথিত হয়, তিনিই তো
হিন্দু। কিন্তু শাক্ত ধর্মে শক্তির এই প্রকাশের মধ্যে এত হিংসা কেন তবে? এই কালী
তো নরমাংস ভক্ষণ করেন।’
ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে হো হো ক’রে হেসে ওঠেন
রামপ্রসাদ। বলেন, ‘মাম্ স খাদিত ইতি মাংস। সেও আমাকে এইভাবে খাবে যেরূপ আমি তাকে
খাচ্ছি। এই হ’ল মাংস কথার অর্থ। ব্রহ্মা বলছেন, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়
সাধন শক্তিরেকা—ছায়েব যস্য
ভুবনানি বিভর্তি দুর্গা—ইচ্ছানুরূপমপি যস্য
চ চেষ্টতে সা—গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং
ভজামি। তিনি যাঁর
ইচ্ছানুরূপ চেষ্টা করেন সেই
আদি পুরুষ গোবিন্দকে ভজনা
করি। হিংসা
কোথায়? সব তো বৈষ্ণব। আমিও শাক্ত বৈষ্ণব। তবে কি জানো, আমার সাধনা সহজিয়া
তন্ত্রসাধনা।
পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালিরাই ভালোবাসাকে প্রেমকে স্বতন্ত্র একটা বিজ্ঞানরূপে
প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তাকে বাঁধতে পেরেছে গুর্জরী ঝিঁঝিঁট রাগে।’
রামপ্রসাদ আবার গান ধরেন। বিভোর হয়ে শুনতে থাকে সবাই সে গান। কালীকীর্তনের সেই
অবিস্মরণীয় বাৎসল্য। সন্ধ্যে হয়ে যায়। লন্ঠন, কুপি জ্বলে
ওঠে। পেছনে
চুপ ক’রে শুয়ে থাকে নিস্তব্ধ নদীচর। শাদা বালি। যেন পরিপাটি ক’রে বিস্তীর্ণ বরফ
পেতে গেছে কেউ। রাতের দিকে ফিরে যায় গাঁয়ের লোকেরা একে একে। কেউ দু’মুঠো খই খেয়ে আটচালার মেঝেতেই চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।
রাতে লালন, রামপ্রসাদ, বঙ্কিম আর কমলকুমার একসাথে খেতে বসেন। ভাত। ঢেঁকি শাক।
আর লাউ খোসা ভাজা। খেতে খেতে লালন খোঁজ নেন আজকের আখড়া কেমন হ’ল। কাল বসবে লালনের
আসর। আবার গাঁ গঞ্জ উজিয়ে আসবে লোকজন। গান হবে। কথা হবে। সাধন কথা। সারাদিন ধ’রে।
খাওয়ার পর, সে রাতে, নদীর ধারে বিস্তীর্ণ চরে ঘাস আর বালির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকেন
রামপ্রসাদ, বঙ্কিম আর কমলকুমার। আকাশের
তারা দেখেন। অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ ধ’রে। বঙ্কিম আর কমলকুমারের মনে ঘুরে যাচ্ছে অনেক
অনেক কথা। প্রশ্ন। ভেতরে ঘুরতে থাকে রামপ্রসাদের ব্যাখ্যাগুলো। কি আশ্চর্য এই দেশ।
কি বিচিত্র এক উপমহাদেশ। কোনও এক বা একক ব’লে যেন কিছুই নেই এখানে। সবাই মিশে আছে সব কিছুর
সাথে। একের থেকে আরেককে কিছুতেই আলাদা করা যায় না। কত বছর আগে এসেছিল আর্য। তারও প্রাচীন এই সাধনতন্ত্র। সেই হরপ্পাতেও ছিল। দ্রাবিড়েও
ছিল। কিভাবে তার সাথে মিশে গেল বৈষ্ণব। বৌদ্ধ। মূলধারার হিন্দু। সহজিয়া সাধনা। এসব ভাবতে ভাবতে কমলকুমার গুন গুন ক’রে সুর
ভাজছিলেন একমনে। পাখি কখন উড়ে যায়।
রামপ্রসাদ বলেন, ‘কমলকুমার, কী ভাবছেন?’
ঘোর ভেঙে কমলকুমার বলেন, ‘উঁ? না, কিছু না।’ কী ভেবে তারপর বলেন,
—‘আচ্ছা, আপনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে এড়িয়ে চলতেন কেন? কত ঐশ্বর্য। যশ। নামডাক হত আপনার।’
—‘তা ব’লে কি চাকরি করব না-কি? অ্যাঁ? আমি সে বান্দা নহি। কার বা কে চাকরি কর,
ওরে তুই বা কে, তোর মনিব কে রে, হলি রে তুই কার নফর। আর দ্যাখো ওদিকে ভারত লিখেছে,
ভারত কহিছে মাগো এই দশ রূপে, দশ দিকে রক্ষা করো
কৃষ্ণচন্দ্ররূপে। রাজভজনাটা দ্যাখো। রাজার প্রসাদ নিলে তাঁর গুণ কীর্তন তাঁর
স্তুতি তো লিখতেই হবে। এসব কি আমি লিখতে পারতাম না-কি? আমার
দ্বারা ওসব হতনি বাবা। কূটনীতি শাস্ত্রচর্চা বিলাস—দূর দূর—ওসব আমার জন্যি নয়। ঝুটা ফুলের অঞ্জলি সব।’
—‘আপনার খুব রাগ বুঝি ভারতচন্দ্রের ওপর?’
—‘রাগের কী আছে? শক্তিশালি কবি। তোমাদের সবার মুখে মুখে তো ওর একটাই লাইন ঘুরে
বেড়ায়। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। আমার কত কত গান ছড়িয়ে আছে সারা বাঙলায়।
আমি সাধনা করেছি মায়ের। ভারত করেছে রাজার।’
—‘আপনার আর কৃষ্ণরামের বিদ্যাসুন্দর নিয়ে লিখে যে উনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন আপনার
রাগ হয় না এই চুরির জন্য?’
—‘আরে আমরাই তো লিখেছিলেম বররুচির কাব্যকে অবলম্বন ক’রে। ভারত কবি হয়েই
জন্মেছিল। ওর মাথাটা খেয়েছে অলঙ্কার শাস্ত্র। আমি খেয়েছি কালীর মাথা। ঘন্ট রেঁধে।
আবার নিজের মাথাও দিয়েছি কালীকে। বনের পুষ্প, বেলের পাতা, মাগো আর দিব আমার মাথা।
আমি তো কোনওখানেই কৃষ্ণচন্দ্রের নাম নিইনি আমার কাব্যে। সেরেস্তার জমিদারের নামও
নিইনি। নেহাৎ রাজকিশোর মুখুজ্জে বলেছিল কালীকীর্তন লিখতে, তাই লিখেছিলেম,
শ্রীরাজকিশোরাদেশে শ্রীকবিরঞ্জন—রচে গান মোহান্ধের ঔষধ অঞ্জন।’
—‘কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র যে আপনাকে ১০০ বিঘে নিষ্কর জমি লিখে দিলেন, গর আবাদী
জঙ্গল ভূমি আবাদ করিয়া পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ভোগ দখল করিতে রহ…’
—‘হাসালে বটে কমল। আমি করব ভোগ, আমি কিনা করব দখল। আরে মন তো কৃষিকাজ জানে না।
এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা, আমিও তো লিখে দিলেম।’
—‘আপনি তো কবিই হতে চেয়েছিলেন। নইলে বিদ্যাসুন্দর তো লিখতেন না। তাহলে গানে
ভিড়লেন কেন? আবার সেভাবে তন্ত্রসাধনাও করলেন না। কালী বলতেই যের’ম একটা হা রে রে
রে ডাকাতদল চোখে ভাসে আপনি সে কালীর কথাও বলছেন না। এ কালী কেমন কালী?’
—‘বিদ্যাসুন্দর তো পড়েছ। গ্রন্থ
যাবে গড়াগড়ি গানে হব ব্যস্ত, এর’ম একটা লাইন লিখেছিলেম তাতে। আর, যোগসাধনা করতাম
তো। কুমারহট্টে করতাম না? কিন্তু, ধন্য দারা, স্বপ্নে তারা, প্রত্যাদেশ তারে। আমি
কি অধম এত বিমুখ আমারে। জন্মে জন্মে বিকায়েছি পাদ পদ্মে তব। কহিবার নহে তাহা সে
কথা কি কব।’
—‘রবীন্দ্রনাথকে কে একজন একবার বলেছিলেন, আপনি নিজের গানের সুরগুলো এত ভুলে
যান কেন? আগে একরকম সুর ভেবেছিলেন, পরে সেটা ভুলে গিয়ে আরেকরকম সুর দিয়ে দিচ্ছেন।
তাতে রবীন্দ্রনাথ নাকি বলেছিলেন, ভাগ্যিস আমি ভুলে যাই, নইলে আমার গানের সব
সুরগুলো রামপ্রসাদের গানের মতো একইরকম হ’ত।’
এ’ কথা শুনে বালির চরে হো হো ক’রে হেসে গড়াগড়ি যান
রামপ্রসাদ। হাসতে হাসতেই বলেন, ‘এর’ম বলেছিল নাকি বুড়ো? তবে, ভাগ্যিস আমি ভুলে যাই না, তাই আমার গানের
সুরগুলো আমারই নিজের সুর হয়।’
—‘আমার তো মনে হয় কবি সমর সেনের চেয়ে কবি রামপ্রসাদ সেন বাঙলা কবিতায় কোনও
অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নন। বরং বেশিই।’
হাতে তালি দিয়ে তড়াক্ ক’রে লাফিয়ে ওঠেন রামপ্রসাদ।
—‘বলো কি গো! আমি তো গীতিকার হে। লোকে তো তা-ই বলে। আমি আবার কবি হলেম কবে!
তবে ওই যে আমি বলি, আমার সাধনা সহজিয়া তন্ত্র সাধনা।’ অন্ধকারে, শূন্যে দু’হাত
ছুঁড়ে বলেন,—‘ধাতু পাষাণ মাটি মূর্তি কাজ কি রে তোর সে
গঠনে। রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজ প্রচারের আগেই আমি লিখে গেছি এ’ গান। আর, ভেবে দ্যাখো,
আমি যখন লিখছি, বেদে দিল চক্ষে ধূলা, ষড়দর্শনের সেই অন্ধগুলা, বাউল জেগে উঠেছে তার
একশ’ বছর আগেই। আমিও তো একটা বাউল। শাক্ত বাউল। আবার দ্যাখো আমার গান, মন তোমারে
করি মানা, তুমি পরের আশা আর ক’রো না। তুমি বা কার কেবা তোমার ভেবে মরো কার ভাবনা।
তার কত পরে লালন লিখেছে, আমি কার, কেবা আমার, বুঝেও বুঝলাম না এবার। কিংবা, তুমি
কার কেবা তোমার এই সংসারে, মিছে মায়ায় মজে কেন এমন করো রে।’
—‘খাব খাব বলি মাগো উদরস্থ না করিব, আপনার এই লাইন যখন পড়ি আমার তো সুকুমার
রায় মনে প’ড়ে যায়। ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না।’
চোখ ছল
ছল ক’রে ওঠে রামপ্রসাদের। অন্ধকারেও তা বোঝা যায়। অপাঙ্গে চিকচিক করে জলবিন্দু। ভেজা ভেজা গলায় বলেন, ‘ঠিকই তো আছে। এরকমই তো হওয়া উচিত। তোমাদের
ওই পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয় কাগজের নামটাও সেরেস্তার এই মুহুরিরই দেওয়া। এ
সংসার ধোঁকার টাটী, ও ভাই আনন্দ বাজারে লুটি।’
—‘আপনি তো খতরনাক লোক মশাই! কপিরাইট দেয় আপনাকে
আনন্দবাজার?’
হাসতে থাকেন রামপ্রসাদ। কমলকুমার ভাবেন, এই লোকটা রাজার ডাক
ফিরিয়ে দিয়েছিল হেলায়। এখন, এইখানে নদীর শাদা ধূ ধূ
চরে ব’সে আছে অন্ধকার রাতে। আজকালকার প্রাইজ পাওয়া লেখক শিল্পীরা এঁকে দেখলে পাগলই
ভাববে হয়ত। বাঙালি আর কোনওদিন কীর্তনের বশবর্তী হবে না। রামপ্রসাদ রচনাবলীও পড়বে
না ভুলে। নিজেকে
নিয়েই কি এ লিখেছিল, নির্বাণে কি আছে ফল, জলেতে মিশায়ে জল, ওরে চিনি
হওয়া ভালো নয় চিনি খেতে ভালোবাসি। আমরা
জগদানন্দের সাথে কবি ষষ্ঠীবরের, রঘুনাথদেবের সাথে মুকুন্দরামের, বিশারদের সাথে
অনন্তরামের, কৃষ্ণচন্দ্রের সাথে ভারতচন্দ্রের, মাগনঠাকুরের সাথে কবি আলাওলের, রাজা
জয়চন্দ্রের সাথে ভবানী দাসের, গৌড়েশ্বরের সাথে বিদ্যাপতি, বিজয় গুপ্ত, মাধবাচার্য,
এমন-কি কৃত্তিবাসের নাম একত্রে পাই। কিন্তু রামপ্রসাদ দাঁড়িয়ে আছেন একা। একক।
বঙ্কিম বলেন, ‘একটা গান ধরুন না সাধক।’
নদীর দিকে তাকিয়ে থাকেন রামপ্রসাদ। দু’চোখ মেলে। দেখা যায় না।
শুধু জলের ভেতর থেকে শব্দ আসে।
—‘গান? সেই কত বছর আগে একটা গান লিখেছিলেম। তখনকার দিনে
ব’সে এরকম একটা গান…। অনেকে বলে,
বুদ্ধ নিরগ্নিক। শঙ্কর নিরগ্নিক। চৈতন্য নিরগ্নিক। কিন্তু তন্ত্র সাগ্নিক।
সম্পূর্ণ কথাটা কিন্তু এরা কেউই বলে না। চৈতন্যের দু’টো অবস্থা। অব্যক্ত আর
ব্যক্ত। নিরগ্নিক আর সাগ্নিক। একটা আরেকটাকে ছাড়া নয়। বুদ্ধের একটা কথা আছে। চেতনা আত্মার আগন্তুক ধর্ম। নদীর জল হ’ল আত্মা। স্রোত
তার চেতনা। খাত হল শরীর। প্রবাহই সব। সে-ই শক্তি। জলকে, আত্মাকে এক স্থান থেকে আরেক
স্থানে সে-ই তো নিয়ে যেতে পারে। আমরা কতটুকুই বা জানি এই পৃথিবীটার, তবু তো মানুষ
বেঁচে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় জানো, একজন অন্ধ কিংবা একজন বধির এই জগৎ ও জীবনটাকে
কিভাবে দেখে, কিভাবে সে গ্রহণ করে, কিভাবে বর্জন, আমি তো জানি না। আমার জানা হ’ল
না। অন্ধের চোখ, বধিরের কান তো আমার নেই। প্রতিবন্ধকতা তবে আমারও আছে? চেতনা
চৈতন্য ক’রে দাও মা। চেতনা চৈতন্য ক’রে দাও।’
কিছুক্ষণ চুপ
ক’রে থাকেন। তারপর বলেন—
‘একটা জিনিস কি
জানো তো, পৃথিবীতে সব সুন্দর পদার্থগুলি পৃথক বস্তু হলেও তাদের মধ্যে একটা
অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। সম্পর্ক এটাই, তারা সুন্দর। বুদ্ধ যেদিন তাঁর শিষ্যদের
বললেন, তোমরা আমার কথাগুলো সংস্কৃতে অনুবাদ ক’রে লিখবে না। আমি যের’ম প্রাকৃতে
বলছি সেভাবেই লিখবে। সেই দিনটা হ’ল এই উপমহাদেশে একটা দিন। মুখের ভাষাকে লেখার
ভাষায় আনার দিন। বেদ-দেব-ব্রাহ্মণ্যবাদের ভাষাকে সরিয়ে মানুষের ভাষাকে জায়গা দেবার
দিন। তার কত কত বছর পরে এইভাবে লেখা হয়েছে পরমহংসের কথামৃত। যাক্ গে… গান গাই বরং…।’
রামপ্রসাদ গান ধরেন। অন্ধকারে চারদিকে যত জোনাকি ছিল, যত ঝিঁঝিঁ-পোকা, পিঁপড়ে, মথ, উঁই, গঙ্গাফড়িং, আরশোলা, বাদুড়, চামচিকে, রাতচরা পাখি, প্যাঁচা, গ্রামীণ সাপ, জলজ পোকা, ব্যাঙ, মাকড়সা, ইঁদুর সব এসে
একে একে ভিড় ক’রে বসে তাঁর পাশে। গান শোনে চোখ মুদে।
...তারা গণ্ডযোগে জন্ম আমার।
গণ্ডযোগে জনমিলে সে হয়
মা-খেকো ছেলে।
এবার
তুমি খাও কি আমি
খাই মা, দুটার একটা
করে যাব।
হাতে
কালী মুখে কালী, সর্বাঙ্গে
কালী মাখিব।
যখন
আসবে শমন বাঁধবে কসে,
সেই কালী তার মুখে
দিব।
খাব
খাব বলি মা গো
উদরস্থ না করিব।
এই
হৃদিপদ্মে বসাইয়ে, মনোমানসে পূজিব।
যদি
বল কালী খেলে, কালের
হাতে ঠেকা যাব।
আমার
ভয় কি তাতে, কালী
ব’লে কালেরে কলা
দেখাব।
ডাকিনী
যোগিনী দিয়ে, তরকারি বানায়ে
খাব।
তোমার মুণ্ডমালা কেড়ে নিয়ে অম্বল সম্বরা
চড়াব।
(চলবে)
অসাধারণ পড়লাম...অসাধারণ!
ReplyDeleteআগের পর্বগুলো কোথায় পাবো?
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteফেসবুকে আমার 'নোটস্'-এ প্রকাশিত প্রতিটি পর্বের লিঙ্ক ক্রমান্বয়ে দেওয়া আছে।
Deleteআগের পর্বগুলি কই ?
ReplyDeleteফেসবুকে আমার 'নোটস্'-এ প্রকাশিত প্রতিটি পর্বের লিঙ্ক ক্রমান্বয়ে দেওয়া আছে।
Delete