রূপনগর
রূপনগর আমার হাত থেকে একদিন কেড়ে নিয়ে গেছে চালতার
ব্যাগ। আমার প্রিয় চালতাফুল, যাকে বড় হতে দিয়ে
একদিন ছ’টাকায় উঠে পড়ি এই নগরের ট্রেনে; সঙ্গে ইলিশ পোড়ার ঘ্রাণ, কাগজী লেবু, অথৈ দীর্ঘশ্বাস... এই ফাঁকে মাটির হাঁড়িতে জল, শিং মাছের ঝোল— এই নিয়ে ট্রেনের কামরায় কামরায় কেউ গান ধরে দিলে
ঝিলপাড় থেকে ডগাভাঙা দুবলার কষে কেউ কেউ ধুয়ে নেয় হৃদয়ের ক্ষত। আর তাতে বনমরিচ, বুনো বিছুটির মতো টগবগ করে ছুটে যায় ট্রেন উত্তরের
দিকে। আর আমি দুধভরা গাভীর ওলান ভেবে দুই হাতে খুঁজে পাই পুরু ফ্রেমের তলে ফোলা ফোলা
চোখের অসুখ। বাঁশবাগান, ঘাসফুল, প্রাচীন হালটের ঢালে বাতাবিলেবুর ফুলে এমন আষাঢ়ের
দিনে, একদিন মৌমাছি তুলেছিল বৃষ্টির
ভাষা; অথৈ সবুজ থেকে নুয়ে পড়া স্নেহের
গভীরে বসে চালতাফুল, ক্রমে তারা ফিরে
পায় বহুরঙ মানুষের রূপ।... রূপনগর, এই প্রিয় অভিবাস
মুখরতা কোলাহলে ছায়াহীন ভালবেসে বসে আছে অজস্র স্টেশন শেষে
বাংলাদেশে একদিন ইংলিশ রোড নামকরণ হলো
আমার নাম দাও শিবপোকা। শিবপোকা মানে, একটি নতুন পোকার নামকরণের ক্ষমতা।... তুমি করো দোয়েলের
চাষ। দোয়েল কি পরিযায়ী নাম? ইংলিশ রোডের কোলাব্যাঙগুলো
সেবার বর্ষায় ছিল সাদারঙ হয়ে। আমি জানি,
এ প্রকার
জলসাদা ব্যাঙ পৃথিবীতে কখনো ছিল না। এমন ব্যাঙরঙ ধরে যখন ভোর হয়, আবার কৈবর্তপাড়ায় ভেঙে যায় রাজ্যের নিয়ম। কেমন আফিমগন্ধে বাজারের
আঁশটের ভেতর আমি শিব শিব করে পোকা হয়ে উড়ি তোমার তালাশে।... তুমি করো দোয়েলের
চাষ।... ভাল ছাইরঙ বোঝো।... মেটে কলসি,
লাউয়ের
খোঁড়লে কী গভীর সুর তুলে আনো। তোমাকে জানাই তাহলে,
আমাদের
ইংলিশ রোডের কোলাব্যাঙগুলো আমার জিহ্বার তল থেকে একদিন তুলে নিয়ে গেছে সমস্ত লালা। সেই থেকে সুরহারা
হয়ে শীতল শস্যের মতো তোমাকে সযত্নে
রাখি
ঘরের নিভৃত কোণে। তুমি তো জানো,
কতোটা
বেসুরো হলে হাটের গুঞ্জন ওড়ে আকাশে বাতাসে
প্রাক-বৈবাহিক
একবার আমাকে একটি বিবাহ-উপযুক্ত মেয়ের হস্তাক্ষর
পাঠিয়ে বলা হলো, এই মেয়ে এতদিন জলেই
বসবাস করেছেন; আর তার সাম্প্রতিক
স্যাঁতসেঁতে প্রকাণ্ড শরীর রৌদ্রে শুকোতে দেয়া আছে। তার হস্তাক্ষরে এই যে কোথাও
মাত্রা পড়েছে বা পড়েনি, আর এই যে যতিচিহ্নের
কোথাও ভুল বা কোথাও সঠিক ব্যবহার—
এসব
কিছুই নাকি মেয়েটির যথার্থ যোগ্যতা বা দোষগুণ যেটাই ধারণা করা হোক। মেয়েটির উচ্চতা আমাদের
মাঠভর্তি জলের সমান, অর্থাৎ এটা আমার
আন্দাজ করে নেয়ার কথা। যা হোক, আমি মায়ের কাছ থেকে
পত্রমারফত এ সংবাদ জেনেই কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নপত্র তৈরি করেছি। আর ভাবছি, মীন রাজ্যের অধ্যয়ন পর্বে মেয়েটির দীর্ঘ বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনে এসব প্রশ্ন খুব একটা কমন পড়ার কথা নয়। আর তাহলে এভাবে হস্তাক্ষর পাঠিয়ে এক জননীর কোনো
অনাথ যুবকের এ মতো মন ভোলানোর কোনো মানেই হয় না। ভেবে দেখছি, আমার অপেক্ষার দিনগুলো কী উৎকণ্ঠার! শীত কিংবা
বর্ষাই আমার প্রিয় ঋতু হলেও ভাবছি,
তাকে
ভেজা জবুথবু নাকি শীতে কোঁকড়ানো দেখতেই বেশি আনন্দদায়ক হবে। আজ এই মুখর বর্ষণে ছাতা হাতে
বৃষ্টি বাঁচিয়ে এমনতর ভাবনাগুলোই পোস্টাপিস অবধি পৌঁছে দিয়ে এলাম। আর তখনই আমার হঠাৎ
মনে এলো— তাকে শেষ প্রশ্নটি করাই হয়নি
যে, অবশিষ্ট জীবনে তিনি মীন ধর্মেই
ফিরে যেতে আগ্রহী কিনা
প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায়—
কবি জীবনানন্দ দাশ প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে ট্রামের
লাইনে চমৎকার চিত্র নির্মাণ করতে পারতেন
কলকাতার প্রেক্ষাগৃহ ঘুরে মধ্যরাতে স্ত্রী লাবণ্য
দাশের তৎকালীন নারী জীবনের স্বাধীনতা বিষয়ে অনেক গল্প শোনা যায়। শোনা যায় : বিদূষী
লাবণ্য দাশ উনুনের পাশে শুয়েবসে কী করে শীতরাত্রির গল্প ফেঁদে কাঁচামাটির পাত্রের মতো
আগুনে পুড়িয়ে নিতে পারতেন। আর পুরোটা জীবনের এ দীর্ঘ অবসরে জীবনানন্দ দাশ কতগুলো সোনার
ডিম চুলায় তুলে কিছু তাঁর জীবদ্দশায় আর বাকিগুলো তাঁর মৃত্যুর পর আপামর পাঠকের জন্য
পরিবেশন করে যান। আমরা তাঁর কাছে বনলতা সেনের অনেক গল্প শুনি। তবু, কোনো এক মানবীর মনে তাঁর ঠাঁই না হবার অপার বেদনার
কথায় এতটুকু বিচলিত কেউ নই; কারণ, একবার সুরঞ্জনা অন্য যুবকের প্রতি আসক্তি বাড়িয়ে
বনলতা বিষয়ে এক গভীর জটিলতা তৈরি করে বসেন। আর তাতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, ভাবনার পূর্ব থেকেই তিনি কখনো বনলতাকে একক মানবীর
মর্যাদা দিতে পারেননি। কলকে পাড় শাড়িতে জড়িয়ে যে কিশোরী সন্ধে হলে ঘরে ধূপ দিতে যায়
প্রতিদিন— বরং তাকে ঘিরেই তাঁর জীবনে
নারীপ্রেম সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা করা যায়। এবং ধারণা করা যায় যে, এরই পরিণতিতে তিনি হায় চিল নামের কবিতাটি লিখে
থাকতে পারেন, এবং আমার সকল গান
তবু তোমারেই লক্ষ্য করে— বলে তাঁর ভালবাসার
চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ঘটান। আশৈশব তিনি জলসিড়ি বিশালাক্ষীর তীরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন— আমার মতন আর নাই কেহ! আমার পায়ের শব্দ শোনো— নতুন এ— আর সব হারানো—
পুরনো। যেহেতু তিনিই কেবল
ঘাইহরিণীর প্রতি অপার মমতা হেতু একদিন ক্যাম্পে লিখে গভীর সমালোচিত হন; নির্জন খড়ের মাঠে পৌষ সন্ধ্যায় হেঁটে হেঁটে রচনা
করেন বাঙালির পরিভাষা— রূপসী বাংলার কথামালা। সেই হেতু এই মহাপৃথিবীতে
যার যেখানে সাধ চলে গেলেও তিনি এই বাংলার ’পরেই আমৃত্যু থেকে
যেতে অভিলাষী হন। আবার বছর কুড়ি পরে—
হারানো
মানুষীর সাথে দেখা হয়ে গেলে— এই কাশ-হোগলার মাঠের
ভেতরেই যেন দেখা যায় তারে— অথবা হাওয়ার রাতে— এশিরিয়ায়, মিশরে-বিদিশায় মরে যাওয়া রূপসীরা যখন এই বাংলার আকাশে কাতারে
কাতারে নক্ষত্রের সমুজ্জ্বল সংসার রচনা করে—
তেমনি
তারার তিমিরে। আবার আট বছর আগের একদিন— কল্পনার নক্ষত্রচূড়ায়
এক মৃতের গল্প রচনা করে বলেন— তবু জানি— নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ— নয় সবখানি;— অর্থ নয় কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়— আরো এক বিপন্ন বিস্ময়— আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে— খেলা করে;— আমাদের ক্লান্ত করে—
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে। জীবনানন্দ দাশ নিশিথের অন্ধকারে
সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে ঘুরে ঘুরে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ বিবেচনা করে বলেন— ভালবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে... ঘৃণা করে দেখিয়াছি
মেয়েমানুষেরে... উপেক্ষা সে করেছে আমারে—
অথবা
জীবনানন্দ দাশ তাঁর সমগ্র অধ্যাপনা ও সম্পাদনা জীবনের প্রগাঢ় বেদনাময় মুহূর্তে নিতান্ত
দুঃখভারাক্রান্ত মনে তাঁর কিছু উৎকৃষ্ট রচনার নামকরণ ধূসর পাণ্ডুলিপি করে অনায়াসে পাড়ি
দেন বাংলা কবিতার ঊষর উদ্যান। একবার খুঁজতে খুঁজতে নক্ষত্রতিমিরে— জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা— বলে যখন সরোজিনীর অবস্থান নির্ণয়ে একপ্রকার ধোঁয়াশায়
পতিত হন— আত্মাভিমানে নিজেও ঝরা পালকের
মতো ঝরে যেতে চান শুকনো পাতা ছাওয়া ঘাসে—
জামরুল
হিজলের বনে— কিংবা নক্ষত্র সকাশে। যেহেতু তাঁর ট্রামের
নিচের জীবন এমনই ইশতেহার রচনা করেছে যে,
যে
জীবন দোয়েলের শালিখের— মানুষের সাথে তার
হয় নাকো দেখা— ফলে, কার্তিকের নরম নরম রোদে— এক পায়ে দাঁড়িয়ে এক সাদা বক— এই দৃশ্য দেখে ফেলে যে, আমাদের নির্জনতম কবি জীবনানন্দ দাশ— এবার মানুষ নয়, ভোরের ফড়িং তারে দেখা যায়— উড়ে উড়ে খেলা করে বাংলার মুখর আঙিনায়—
(চিত্রঋণ : রামকিংকর বেজ)
প্রতিটি লেখা চমকে দিয়েছে মনন ,,,,,,এরকম লেখা আগে পড়িনি,,,,,,,
ReplyDeleteBah... Onyorokom ... Chamatkar -- Renaissance Saha
ReplyDeleteদারুণ দারুণ। এ এক অন্যভাষ্য। শব্দ ব্যবহার আর ভাবনার বিস্তার চমৎকার।
ReplyDeleteকবি,আরো একটু নিকটবর্তী হলাম।
ReplyDeleteওবায়েদ নিরন্তর থেকে যায় লেখার আশ্রয়েই । ভালো ওর সহজাত পাওয়া । ধন্যবাদ ।
ReplyDeleteAmi Mugdho..
ReplyDelete'বাক্' পত্রিকার এই সংখ্যাতেও ওবায়েদ আকাশ এর কবিতা পড়তে পেরে খুব ভালো লাগছে। থ্যাঙ্কিউ অনুপমদা। ওবায়েদদাকে অনেক শুভেচ্ছা।আপনার লেখা নিয়মিত ভাবে পেলে আরও ভালো লাগবে।
ReplyDelete