জুতা-বর্ষণ
মহামতি লেনিন বলেছিলেন জুতোর ক্ষয় দিয়ে শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করা যায়। যায়
কি? নাকি যায় না? লেনিন কি আদৌ এমন বলেছিলেন? লোকশ্রুতি আর লোককথনের ফারাকের কথা
ভাবতে ভাবতে বাঁ-পায়ের বুটের দিকে চেয়ে ছিল প্রভাত। স্ত্রী প্রজ্ঞা কফিমাগ টেবিলে
রেখে শুধোলোঃ ‘কী ব্যাপার বলো তো? হাঁ করে জুতোর দিকে চেয়ে কি দেখছো? মাথাটা গেল,
নাকি?’ প্রভাত বলল, ‘আরে দেখো না, জুতোর সোলেও একটা হাঁ-মুখ হয়েছে। আমি ওকে দেখছি
আর ও আমাকে।’ প্রজ্ঞাঃ ‘জুতোর হাঁ-মুখ তো আগেও ছিল, তার ভেতর দিয়েই তো পা ঢোকাতে। এ
হল পশ্চাৎমুখ। তোমার পায়ের চাপে বেচারার ওষ্ঠাগত প্রাণ হয়েছিল।এবার শ্বাস নিয়ে
বাঁচবে!’ প্রভাতঃ ‘তোমার কি মনে হয়, জুতোয় পেরেক ছিল?’ প্রজ্ঞাঃ ‘হয়ত তাই দেরী
হল।’
এরপর থেকে প্রভাত সন্ধ্যায় ফিরে জুতো খোলবার জন্য বাঁ-পা
তুলতেই প্রতিদিন কিছু না কিছু শব্দ শোনা যেত। জুতোর গর্তে স্টোন-চিপ্স, পাথর-নানা
জিনিস ঢুকে থাকত। গর্তটা যে একেবারে হাট-খোলা ছিল তা নয়।জুতোর সোলে যে ফুটো হয়েছিল
তাকে খানিকটা আড়াল করে রেখেছিল রবারের হাল্কা চামড়া। চামড়ার ফাঁক দিয়ে আঙুল ঢোকালে
মেঝের ওপর প্রস্তরবর্ষণ হত। রান্নাঘর থেকে প্রজ্ঞা শুনতে পেত শব্দটা। প্রতিদিন
নিজেদেরই অজান্তে ঐ শব্দটার থেকে কি যেন চাইত দু’জন। নিজেদের বা অন্যদের বলে
বোঝানোর মত ছিল না সে চাহিদা। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই প্রজ্ঞা অপেক্ষা করত জুতো-ঝাড়ার
ঐ শব্দের আর অফিসে বসে বসে কাজের ফাঁকে বুটিশেকের বদলে প্রভাত ভাবত তার বুটশেকের
কথা। ভাবত কিন্তু বুঝত না। ওরা কি নিতান্তই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল নাকি কোন মির্যাকলের
অপেক্ষা করছিল? দুজনেই তো দেখেছিল ‘পরশ পাথর’ সিনেমাটা।
দেখেছিল তো? দেখেছিল কি?
এইভাবে প্রতিসন্ধ্যার জুতা-আবিষ্কারের শব্দটা কোথাও যেন
একটা নাড়ির টান তৈরি করেছিল প্রভাত-প্রজ্ঞার মধ্যে। জুতোটা বদল করতে ইচ্ছে হত না
প্রভাতের। আর যেদিন বর্ষণ হত না, সেইদিনগুলোর সান্ধ্য নিরবতা শোকে মুহ্যমান হয়ে
থাকতো আর বাড়ির পরিবেশকেও কেমন ভারী করে তুলতো। প্রজ্ঞা একদিন রাতে স্বপ্ন দেখল যে
জুতোর গর্ত থেকে একটা চিঠি বেরিয়েছে। প্রভাত প্রথমে বুঝতে পারেনি। ঝাঁকানো
স্বত্বেও শব্দ না হওয়ায় সে হতাশ হয়ে জুতো দু’খান তুলে রেখেছিল শু-কেসে কিন্তু
প্রজ্ঞা হাল ছাড়বার পাত্রী নয়। চুপিচুপি গিয়ে জুতোটা উল্টোতেই দেখে গর্তের ফাঁক
দিয়ে সাদা একটা কাগজ উঁকি দিচ্ছে। কাগজটা খুলতে চোখে পড়ল সাদা পাতার মধ্যিখানে বড়
করে লেখা রয়েছে পি-পি। পি-পি মানে তো প্র-প্র। প্রজ্ঞা-প্রভাত। সাদা পাতার মাঝখান
থেকে নিশির ডাক, মন যাতে উচাটন হয়ে যায়। নাম ধরে ডেকেই থেমে গেছে কেউ। বাকি কাগজটা
প্রলোভনের মত ফাঁকা। এইখানেই ঘুম ভেঙে গেল আর স্বপ্নটাও বাকি কাগজের মত প্রলোভন
হয়ে উঠল। এরপর থেকে শব্দ না হলেও প্রজ্ঞা দেখতে ভুলত না গর্তের হাঁ-মুখ কথা বলছে
কিনা। শ্রবণ থেকে দৃষ্টির দিকে তার মন হেঁটে গিয়েছিল স্বপ্নের পথে। ‘কখনো সময় আসে।
জীবন মুচকি হাসে। ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা।’
প্রজ্ঞার স্বপ্নের পরের সপ্তাহে প্রভাত ভোররাতে জুতোর
গর্ত নিয়ে ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখল। দেখল একদিন সন্ধ্যেবেলা জুতো ঝাড়তে গিয়ে ঘড়ির
টিক-টিক শব্দ হচ্ছে। গর্তের চামড়া ঠেলতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা টাইম-বম্ব।
ততক্ষণে তার গলা দিয়ে আর শব্দ বেরোচ্ছে না। ঘড়ির শব্দে অবাক হয়ে প্রজ্ঞা বেরিয়ে
আসতে না আসতেই বুম। বিস্ফোরণের সাথে সাথেই ঘুম ভেঙে গেল। প্রভাতলগ্নে মৃত্যুর
আহ্বান রয়ে গেল। স্বপ্নটা উদ্বিগ্ন করে তুলল প্রভাতকে। আজকাল টেররিজমের যুগ। ভরসা
কি? ঠিক করল জুতো না হলেও সোলটা অন্তত পাল্টে নেবে। এনাফ অফ দ্য হোল! ভাবল প্রজ্ঞা
রাগ করবে। তার বড্ড মায়া হয়ে গেছে সন্ধ্যেবেলার ঐ শব্দে। ঠিক করল লুকিয়ে লুকিয়ে
করবে যা করার। সেদিন অফিসে লাঞ্চ ব্রেকে বেরিয়ে জুতোর সোলটা বদলে নিল প্রভাত। আর
ফেরার সময় রাস্তা থেকে দুটো নুড়ি পাথর নিয়ে ফিরল। প্রজ্ঞা যখন রান্নাঘরে কফি
বানাচ্ছে, প্রভাত তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য একটা কৌটোয় ভরে নুড়ি পাথরদুটোকে ঝাঁকালো
কিন্তু সে তো আর জানে না কৌতূহলী প্রজ্ঞা ততক্ষণে কফিমাগ নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে
এসেছে। সে আগে কৌটোর দিকে তাকাল তারপর জুতোর নতুন অক্ষত সোলের দিকে। তার মুখ দেখে
প্রভাতের মনে হল গর্তটা যেন এক সোল থেকে আরেক সোলে প্রবেশ করছে। ফারাক শুধু
বানানের। প্রজ্ঞা শুধোলোঃ ‘কী? আজ কি নতুন কিছু পেলে নাকি সেই একগাছা পাথর?’
প্রভাত প্রথমে অবাক হয়ে গেছিল, সব দেখেশুনেও প্রজ্ঞা একথা কেন বলছে কিন্তু তারপর
শান্ত গলায় বললঃ ‘না, নতুন কিছু নয়। দুটো নুড়ি পাথর।’ কৌটো খুলে পাথরদুটো মেঝেতে
ফেলে দিল প্রভাত আর তারাও বারকতক নড়েচড়ে সুবোধ বালকের মতো মেঝের ওপর স্থির হয়ে
গেলো। প্রজ্ঞা শুধোলোঃ ‘তোমার কি মনে হয়, জুতোয় পেরেক ছিল?’ প্রভাত বললঃ ‘হয়ত তাই
দেরী হল।’
এরপর থেকে প্রভাত প্রতিদিন দুটো করে নুড়ি পাথর নিয়ে আসতো
সন্ধ্যেবেলা। আর একই পুনরাবৃত্ত কথোপকথনের পর প্রজ্ঞা পাথরদুটো তুলে নিয়ে গিয়ে
বারান্দায় রেখে আসতো। এইভাবে একদিন দেখা গেল তাদের বারান্দা পাথরে পাথরে ভরে গেছে
আর উপচে পড়ছে নিচের রাস্তায়। ‘অনেক দিনের পর। মিলে যাবে অবসর। আশা রাখি পেয়ে যাবো
বাকি দু’আনা।’
(চিত্রঋণ : ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ)
ভালো লেগেছে। আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায়। জুতোয় পেরেক ছিল। এই কবিতা-লাইন ভেঙে ভেঙে, ঘটনা অ-ঘটনার পথ ধরে একটা অবয়ব গড়ে তুলল যেন। আর আশা, বাকি দু আনার জন্য। কবিতার পাশ দিয়ে বয়ে চলল এই গল্পনা। নাকি গল্পই !
ReplyDeleteEta osamanyo laglo. Ei golpo ta niye daarun ekta animated short film Kora jay mone hochhe.
ReplyDeleteআমারও একটু দেরি হল। হয়তো মুগ্ধতা-
ReplyDeleteপ্রথম থেকে শেষ শব্দ অবধি ডুবে ছিলাম।দারুণটা আর বললাম না,বললে পাঠপ্রতিক্রিয়ায় আরও গরিব লাগতো বোধহয় নিজেকে।
ReplyDeleteঅন্য রকম ভালো লাগলো
ReplyDeleteবাহ।
ReplyDeleteএই শব্দটিই বেরিয়ে এল পাঠ-শেষে।
অনেকদিন পর বাক এ এলাম।।খুব সুন্দর লাগল গল্পনা।
ReplyDeleteভালো লাগল
ReplyDelete